Dhaka Sunday, February 23, 2025

ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া এরফানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়!


Published:
2020-10-27 08:50:27 BdST

Update:
2025-02-23 00:02:13 BdST

পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ এরফান সেলিম। ঢাকা দক্ষিণ সিটির একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। স্থানীয় একজন সাধারণ কাউন্সিলর হলেও এলাকাবাসীর সঙ্গে তেমন কোনো ধরনের জনসম্পৃক্ততা ছিল না তার। কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যখন যা ইচ্ছে করতেন।

এলাকায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বাবার সঙ্গে অন্যের জমি নেতৃত্ব দেওয়া, বাসার ছাদে নিয়মিত পটকা ফোটানো, অলিগলি ও রাস্তায় দ্রুতগতিতে গাড়ি রেসিং করা, চকবাজারের কুলিদের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে আতঙ্ক তৈরিতে নিজের পিস্তল বের করে গুলি চালানোসহ এরফানের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই।

এলাকাবাসীর কাছে এরফান এক আতঙ্কের নাম। ফলে এলাকাবাসী ভয়ে তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করতেও সাহস পেত না। অনেকে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হলেও থানায় অভিযোগ করত না। আবার কেউ কেউ অভিযোগ করলেও সেগুলো অজানা কারণে ধামাচাপা পড়ে যেত।

এভাবেই এলাকায় আতঙ্ক ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল লালবাগের ৩০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ এরফান সেলিম।
তবে এরফান গ্রেফতারের পর থেকে ভুক্তভোগী, লালবাগের স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা এবং ওয়ার্ডবাসী মুখ খুলতে শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব অজানা তথ্য জানা গেছে।
এলাকাবাসী জানায়, এরফান একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি ছিলেন। বাবা ও শ^শুরের রাজনৈতিক পরিচয় ও অঢেল সম্পত্তির মালিক হওয়ায় কাউকে তোয়াক্কা করতেন না।

তাকে যে স্বপ্ন নিয়ে এলাকাবাসী কাউন্সিলর বানিয়েছিল তা কিছুদিনের মধ্যেই ফ্যাকাশে হতে শুরু করে। তিনি শুধু মাদকাসক্তই নন, পাগলাটে টাইপের হওয়ায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, কথায় কথায় কারও ওপর চড়াও হওয়া, মারধর করা, বাবার ক্ষমতা দেখানো, ৮ থেকে ১০ জন নিরাপত্তা কর্মী নিয়ে ভিআইপি স্টাইলে ঘুরে বেড়ানো, মদিনা আশিক টাওয়ারের ছাদে উঠে ফটকা ফোটানো ছিল তার নেশা।

রোববার রাতে নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্টকে মারধর করেন এরফান। এমন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নতুন নয়। এর আগেও অনেক স্থানীয় নেতাকর্মী এবং এলাকার ব্যক্তিদের ওপর কোনো প্রকার দোষ ছাড়াই পেটানোর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কোনো ঘটনাতেই তাকে আটক বা গ্রেফতার হতে হয়নি।


ভিআইপি স্টাইলে চলাফেরা : এলাকাবাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, এরফান বাবার ক্ষমতাকে কাজে লাগাতেন। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগ থেকেই তিনি ছিলেন বেপরোয়া ও পাগলাটে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কাউকেই পাত্তা দিতেন না।

জমিদারি স্টাইলে কথা বলতেন ও চলতেন। তারা আরও জানিয়েছে, এরফান একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। কিন্তু তার চলাফেরা ছিল মন্ত্রীর মতো। মন্ত্রীর মতো নিরাপত্তা প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করতেন। তার নিরাপত্তা গ্রুপে বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চাকরি দিতেন। তাদের নিয়েই সবসময় চলতেন। সঙ্গে থাকত একটি ব্যক্তিগত পিস্তলও। কোনো জায়গায় বের হওয়ার আগে পুরো রাস্তা ফাঁকা করত তার নিরাপত্তাকর্মীরা। এরফানের সামনে ও পেছনে থাকত দুটি গাড়ি। প্রতি গাড়ি থেকে নিরাপত্তা কর্মীরা হুইসেল দিত এবং রাস্তা ফাঁকা করার জন্য আওয়াজ দিত অন্যান্য যানবাহনকে।
আজিমপুরের সুমন নামে এক বাসিন্দা বলেন, এরফানের জ্বালায় এলাকায় থাকা মুশকিল ছিল। রাস্তা দিয়ে গেলে বোঝাই যেত হাজী সেলিমের ছেলে এরফান যাচ্ছে। দেহরক্ষীদের চিৎকার আর গাড়ির হুইসেলে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। অথচ তিনি একজন কাউন্সিলর। তার ভাবখানা এমন ছিল তিনি যেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বড় কিছু।

ওয়ার্ডের অনেকে জানিয়েছে, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার ভাব বেড়ে যেতে থাকে। আগাম জানানো ছাড়া কাউকে তার বাসায় প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলেও কাউকে খুব সহজে তিনি বাসায় ঢোকার অনুমতি দিতেন না। ফলে ওয়ার্ডবাসী ছিল তার প্রতি চরম বিরক্ত।


অফিসে ছিল টর্চার ও পিস্তলের ভয় : এলাকাবাসী জানিয়েছে, এরফানের ওপর এলাকায় কেউ কোনো কথা বলতে পারত না। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে ডেকে নিতেন তার অফিসে। এরপর সেখানে চলত ব্যাপক মারধর। বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে এনে তিনি ও তার লোকজন হ্যান্ডকাফ পরিয়ে মারধর করতেন। এলাকায় কেউ তার সমালোচনা করে বক্তব্য বা আলাপ-আলোচনা করলেই তার লোকজন তাকে ওয়াকিটকিতে সেই খবর দিত।
অন্যদিকে চকবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে, এরফান কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর কারও দোকান বা মার্কেটের ওপর তার নজর পড়লেই তাকে পিস্তলের ভয় দেখাতেন এবং চাঁদাবাজি করতেন। এভাবে তিনি বেশ কয়েকটি জায়গা ও মার্কেট দখল করেছেন বলে জানায় তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ছয়-সাত মাস আগে এরফানের বিরুদ্ধে চকবাজার এলাকায় পিস্তল বের করে গুলি চালানোর অভিযোগ করেছে সেই এলাকায় কর্মরত কুলি ও দিনমজুরা। তারা জানিয়েছে, সেদিন রাতে এরফান তার গাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। কিন্তু ওই সময় রাস্তায় গাড়ির জট ও কুলিরা বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তিনি দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে কুলিদের ওপর তুলে দেন। এ সময় গাড়ি থেকে নেমেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং নিজের সঙ্গে থাকা পিস্তল বের করে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। এতে সেখানে থাকা কুলিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এলাকায় এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। দিগ¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকে কুলি ও মজুররা। এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না হয় তার জন্য অনেককে ভয়ভীতিও দেখিয়েছিলেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।


দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো ছিল নেশা : স্থানীয়রা আরও জানিয়েছে, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো ছিল এরফানের নেশা। রাত হলেই তার সাঙ্গপাঙ্গ ও ৮ থেকে ১০ জন দেহরক্ষী নিয়ে রাস্তায় বের হতেন। কাউকেই তিনি কোনো ধরনের তোয়াক্কা করতেন না বলে জানিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও এলাকাবাসী। সাবেক এক যুবলীগ নেতা বলেন, এরফানের স্ত্রীর বড়ভাই সাবাব চৌধুরী কয়েক বছর আগে জাতীয় সংসদের সামনে এক ব্যক্তিকে গাড়িচাপা দিয়েছিলেন। এরফানের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে। তারা তো পুরো পরিবারটাই পাগলাটে আর কেমন জানি। কিন্তু তিনি হাজী সেলিমের ছেলে বলে হাজারও অপরাধ করে বারবার রক্ষা পেয়েছেন। এসব বিষয়ে অভিযোগ পেলেও পুলিশ কখনই তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এবার তাকে ধরা পড়তেই হয়েছে।

এদিকে,গ্রেপ্তারের আগে মদ্যপ অবস্থায় ইরফান সেলিম র‌্যাব সদস্যদের উদ্দেশে বলতে থাকেন 'হু আর ইউ? অ্যাম আই এ ক্রিমিনাল? উইল ইউ অ্যারেস্ট মি?'

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ৪ তলার ইরফানের কক্ষটি ভেতর থেকে লক করা ছিল। বাড়ির কেয়ারটেকারকে সঙ্গে নিয়ে সেই রুমে যান অভিযানকারীরা। কেয়ারটেকারের ডাকে দরজা খোলেন ইরফান। এসময় তিনি ঢুলছিলেন। তখন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তাদের সাথে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন।

এর আগে হাজী সে বা‌ড়ি‌তে অভিযান চা‌লি‌য়ে আগ্নেয়াস্ত্র, মদ, বিয়ার ও ওয়া‌কিট‌কিসহ বিপুল প‌রিমাণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম উদ্ধার ক‌রেছে র‌্যাব। সোমবার দুপুর ১টা থে‌কে সা‌ড়ে ৩টা পর্যন্ত চকবাজা‌রের ২৬ নম্বর দেবীদাস ঘাট লেনের বা‌ড়ি‌তে অভিযান চা‌লি‌য়ে সাংসদপুত্র মোহাম্মদ ইরফান সে‌লিম‌কে আটক করা কা‌লে বা‌ড়ি তল্লা‌শি চা‌লি‌য়ে ওইসব দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। অভিযানের নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যা‌জি‌স্ট্রেট স‌রোয়ার আলম।

অভিযান শেষে মাদক ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখা ও ব্যবহার করার দায়ে মো. ইরফান সেলিমকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় ইরফানের দেহরক্ষী মো. জাহিদুলকে ইসলামেও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

র‍্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ধারণা করছেন ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা এবং ঢাকা শহরে অবৈধভাবে কোনো সিগন্যালিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হতো। এজন্য তিনি অবৈধভাবে ভিপিএস ডিভাইস ব্যবহার করতেন।

বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই তিনি তার বাসায় এই ভিপিএস ডিভাইসের মাধ্যমে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কিং সিস্টেম করেছিলেন।



Topic:


Leave your comment here:


Most Popular News
Top