Dhaka Sunday, April 28, 2024

দুদকের জালে নগর ভবনের সেই ইউসুফ সরদার


Published:
2020-09-03 22:42:35 BdST

Update:
2024-04-28 23:45:42 BdST

হুন্ডি ও নানা উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করে বাড়ি কিনেছেন কানাডার টরন্টো শহরের সেই বিখ্যাত বেগম পাড়ায়। সেখানে খুলে বসেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কানাডায় স্থায়ীভাবে পাঠিয়ে দিয়েছেন স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। তিনিও পালানোর চেষ্টা করেন সেখানে, কিন্তু পারেননি। গাজীপুর সদরের মনিপুরি বাজারের পরিবাজার সংলগ্ন এলাকায় করছেন আধুনিক রিসোর্ট। পাবনা সদরের দৌগাছি ইউনিয়নের পিপড়ি গ্রামে এক দাগেই কিনেছেন কয়েকশ বিঘা জমি। রাজধানীর

গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট, আহসান মঞ্জিল সুপার মার্কেট এবং আজিমপুর ঢাকেশ্বরী রোডসাইড মার্কেটসহ বিভিন্ন বিপণিবিতানে ছয়শ’র বেশি দোকান বরাদ্দ ও বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকা। এতসব অভিযোগ উঠেছে নগর ভবনের ‘শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা’ হিসেবে আলোচনায় থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চাকরিচ্যুত প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে। তাকে চেয়ারে বসেই চাকরিচ্যুত করেন বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এই বহুল আলোচিত ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জানা গেছে, ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া অভিযোগের তদন্ত করতে কমিশনের সহকারী পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুসন্ধাকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি আগামী ৮ সেপ্টেম্বর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য দিতে ইউসুফ আলী সরদারকে তলবি নোটিস পাঠিয়েছেন। রাজধানীর ৪৪/১, শান্তিনগরের ঠিকানায় পাঠানো দুদকের ওই নোটিসে ইউসুফ আলীর নাম সরদারের পরিবর্তে ইউসুফ আলী সরকার লেখা হয়েছে।

দুদকের পাঠানো নোটিসে অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে বলা হয়, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বে থাকা ইউসুফ আলী সরকার (বর্তমানে চাকরিচ্যুত) ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎপূর্বক শতকোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।’ ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে বছর পাঁচেক আগেও দুদক অনুসন্ধানে নেমেছিল দুদক। কিন্তু ওই সময় তিনি একজন প্রভাবশালী কমিশনারের আশীর্বাদ নিয়ে পার পেয়ে যান বলে জনশ্রুতি রয়েছে। গুলিস্তান এলাকার একাধিক মার্কেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত একজন সংসদ সদস্যের আশ্রয়ে থেকে ইউসুফ আলী সরদার দুদকের জাল থেকে বেরিয়ে যান। অনুসন্ধানের তথ্য নথিভুক্ত করে তখন তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।

ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দুদিনের মাথায় এবং অফিস করার প্রথম দিনই গত ১৭ মে চাকরিচ্যুত করেন ইউসুফ আলী সরদারকে। তিনি সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন উল্লেখ করে দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, ইউসুফ আলী সরদারকে বলা হতো সাবেক মেয়রের ‘ক্যাশিয়ার।’ প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা সিন্ডিকেট ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা। সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসের হাত ধরে উত্থান হলেও বিদায়ী মেয়রের আমলে পুরো করপোরেশনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়েন ইউসুফ আলী। সিটি করপোরেশনে প্রায় ২৫ বছর চাকরি করা এই কর্মকর্তা সর্বশেষ প্রায় তিন বছর প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করেন। মির্জা আব্বাস পূর্তমন্ত্রী থাকার সময় তিনি ঢাকার পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। চতুর ইউসুফ আলী সরকার তার স্ত্রী শাহিদা আক্তার ও ছেলেমেয়েকে আগেই কানাডায় পাঠিয়ে দেন। ২০১০-১১ সাল থেকে কানাডায় বসবাস করছে তার পরিবার। চাকরিচ্যুত হওয়ার আগেই ইউসুফ আলী কানাডায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে বিগত ১০ বছরে তিনি অন্তত ১০ বার কানাডা ভ্রমণ করেন। ইউসুফ আলী কানাডার সেই বিখ্যাত বেগম পাড়ায় আলিশান বাড়ি কিনেছেন। ইউসুফ আলী বাংলাদেশের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বলে কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে মনে করেন। তার চালচলন ও জীবনযাত্রার মান দেখে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এমন ধারণা করেন।

ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ডিএসসিসির এলইডি বিজ্ঞাপনের কমিশন হিসেবে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়া বাজারসহ রাজস্ব আদায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একক নিয়ন্ত্রক। নগর ভবনসহ ডিএসসিসির পুরো ৫ অঞ্চলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিন। নিজের চক্রের মাধ্যমে প্রশাসনিক অনিয়ম ও নিয়মবহির্ভূত পদায়নের মাধ্যমে অবৈধভাবে আয় করেন কোটি কোটি টাকা।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, দোকান বরাদ্দ এবং অবৈধ পন্থায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি-পদায়নসহ ডিএসসিসির প্রায় সব অনিয়মের সঙ্গে ইউসুফ আলী জড়িত থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার অবৈধ উপার্জনের অধিকাংশই নিজের নামে না রেখে রেখেছেন স্বজনদের নামে-বেনামে। তার ভাই ইউনুস আলী সরদারের নামেও রয়েছে অঢেল সম্পদ। ডিএসসিসির রাজস্ব আদায় ও রোপ, নতুন হোল্ডিং নম্বর ইস্যু, নিজস্ব সম্পত্তি থেকে রাজস্ব আদায়, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন, রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স ইস্যু, মার্কেট বরাদ্দ ও দোকান থেকে রাজস্ব আদায় এবং প্রমোদ কর আদায় ও সংগ্রহ করে বিভাগটিতে কর্মরতদের অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আর এসব কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ ছিল ইউসুফ আলী সরদারের নেতৃত্বে গড়ে তোলা চক্রের।

জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন মার্কেটের ৭ হাজার ২শ দোকান বরাদ্দের নামে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে। কিন্তু তিনি অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে মামলা থেকে রেহাই পান।

দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য  বলেন, ‘ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তা আমলে নিয়ে কমিশন তাকে তলবি নোটিস পাঠিয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউসুফ আলী সরদার  বলেন, ‘আমি দুদকের চিঠি পেয়েছি। নোটিসে অভিযোগ যা লেখা হয়েছে সেটার কোনো সত্যতা আছে বলে আমি মনে করি না। আমাকে সুনির্দিষ্ট কী কারণে দুদক তলব করেছে, আমি আগামী ৮ তারিখে গেলে সেটা জানতে পারব এবং আপনাদের জানাব।’



Topic:


Leave your comment here:


Most Popular News
Top