Dhaka Sunday, April 28, 2024

তিতাসের লোভের বলি মসজিদের মুসল্লিরা!


Published:
2020-09-06 12:57:57 BdST

Update:
2024-04-28 04:37:08 BdST

গত ১৫ দিন ধরেই মসজিদের ভেতরে গ্যাসের ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া যেত। বিশেষ করে মাগরিব ও এশার নামাজের সময় বেশি গন্ধ থাকত। কারণ এই সময় মসজিদের দরজা-জানালা বন্ধ থাকত ও এসি চলত। মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে এসে অস্বস্তিবোধ করতেন। কয়েক দিনে মসজিদটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। মসজিদের ইমামের নজরেও বিষয়টি এনেছিলেন মুসল্লিরা। পরে মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় কয়েকজন মসজিদ কমিটিকে জানান, তারা দেখেছেন, মসজিদের মেঝের নিচের পাইপলাইন থেকে গ্যাস লিকেজ হয়ে টাইলসের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে। ফলে সবারই চোখ জ্বালা করে। নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদ কমিটি, মুসল্লি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

তারা  বলেন, এরপর মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের তিতাস অফিসে যোগাযোগ করা হয়। তারা এসে দেখেও যান। কিন্তু গ্যাসের পাইপলাইনের কাজ করতে তিতাস কর্র্তৃপক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে। মসজিদ কমিটি আর টাকা-পয়সা দেয়নি। ফলে গ্যাস লিকেজ অব্যাহত থাকে। গত শুক্রবার এশার নামাজের সময়ই ঘটে চরম বিপর্যয়।

মসজিদ কমিটি, স্থানীয় মুসল্লি ও অন্যরা বলছেন, ৫০ হাজার টাকার জন্য এতগুলো নির্দোষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এটা দুর্ঘটনা নয়। এটা হত্যাকাণ্ড। ঘুষ চাওয়া এবং গাফিলতির জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও দাবি জানান তারা।

তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আল মামুন গতকাল শনিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, এই ঘটনা তদন্তে তিতাস থেকে কমিটি করা হয়েছে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর এমডি মো. আল মামুন সাংবাদিকদের বলেছেন, মসজিদে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় তিতাসের কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে গ্যাস লাইনের লিকেজের পাশাপাশি এই মসজিদের নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মসজিদটিতে ৬টি এসি চালানোর মতো সক্ষমতা রয়েছে কি না এবং মসজিদটি রাস্তার ওপর এতখানি কীভাবে এলো সে প্রশ্নও উঠেছে। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করে এরকম অনেক অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। মসজিদের নিচ দিয়ে কীভাবে গ্যাস লাইন করা হয়েছে সেই প্রশ্নও উঠে এসেছে। খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু নিজেই এসব প্রশ্ন তুলেছেন।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল রাতে  বলেন, গ্যাস লাইনের লিকেজ নিয়ে তিতাসের গাফিলতির বিষয়টি নতুন নয়। গতকালকের ঘটনার পর থেকে তিতাস কর্র্তৃপক্ষকে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গ্যাস লাইনগুলোর অবস্থা জানিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে সেক্ষেত্রে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল রাতে  বলেন, ‘এ ঘটনায় অভিযুক্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ মসজিদের নিচের লিকেজ গ্যাস লাইনটি সারাতে তিতাস গ্যাস কর্র্তৃপক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছিলএই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে দুটো বিষয়। এক. এখানে গ্যাস লাইন এলো কীভাবে এবং এই গ্যাস লাইনের ওপরে মসজিদ নির্মাণ হলো কীভাবে? যদি তাই হয়ে থাকে তবে এটা অবৈধ। এটা যারা নির্মাণ করেছেন তাদেরও শাস্তি হওয়া দরকার। যারা এখানে অবৈধভাবে সংযোগ নিয়েছেন তাদেরও শাস্তি হওয়া দরকার। আমার বিভাগের যেকোনো কর্মকর্তার যদি গাফিলতি থাকে তাহলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

জানা গেছে, মসজিদটির বয়স ১৪-১৫ বছর। কিন্তু বছর দুয়েক আগে কাউকে না জানিয়ে মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়। ওই সম্প্রসারিত অংশের মধ্যেই গ্যাস পাইপলাইন পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এ বিষয়টি তিতাস কর্তৃপক্ষের আগেই দেখা উচিত ছিল। আবার এমনও হতে পারে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মসজিদ কমিটির যোগসাজশে এমনটি হয়েছে।

গতকাল সরেজমিন আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে গেলে কয়েকজন মুসল্লি জানান, মসজিদের নিচ দিয়ে গ্যাস লাইনের পাইপ বসানো ছিল। নামাজ পড়তে এলেই পাওয়া যেত গ্যাসের গন্ধ। এ বিষয়ে মসজিদ কমিটির মাধ্যমে একাধিকবার জানানো হয়েছিল তিতাস কর্র্তৃপক্ষকে। তবে তারা এ বিষয়টি আমলে নেয়নি। তাদের গাফিলতিতেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে।

মসজিদ কমিটির সদস্য দেলোয়ার হোসেন  বলেন, ‘পাইপ মেরামত করতে কমিটির পক্ষ থেকে আমরা তিতাস কর্র্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েছি। কিন্তু তারা টাকা দাবি করলে এ বিষয়ে আর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।’

তিতাসের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. মুকবুল আহম্মদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নারায়ণগঞ্জে মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরণে বিপুল হতাহতের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা হয়েছে। কারও গাফিলতি থাকলে তার চাকরি থাকবে না এবং সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

নসরুল হামিদ বলেন, আমি দেখলাম এখানে অনেকে অবৈধ গ্যাস সংযোগ চালাচ্ছে। কোনো অঘটন ঘটলে আমরা সবাই সচেতন হই। গুটিকয়েক অফিস নিয়ে সারা দেশের সার্ভিস সম্ভব নয় জনগণ যদি সহযোগিতা না করে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, মসজিদে যেভাবে এসি লাগানো হয়েছে এবং বিদ্যুতের যে লোড ব্যবহার করা হয়েছে সেটা নিয়মবহির্ভূত। এই ধরনের মসজিদে এতগুলো এসি ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক। এই মসজিদটিতে কীভাবে এত লোড ব্যবহার করা হলো তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা করা দরকার। তারা যে এসি ব্যবহার করছেন, যে বিদ্যুতের লোড ব্যবহার করছেনসেগুলো তারা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। তারা স্থানীয় ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। সেখানে নিম্নমানের তার ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কারণে প্রায়ই শর্টসার্কিট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে মসজিদটি রাস্তার ওপরে। সামনে দিয়ে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়েছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারলাম এখান দিয়ে গ্যাস লাইন গিয়েছে। তদন্তের পর বোঝা যাবে কোথা থেকে কোন গ্যাস লাইন এসেছে। এখানে অনেক অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। নিম্নমানের জিআই পাইপ দিয়ে লাইনগুলো টানা হয়েছে। কারও কোনো মিটার নেই। আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন করার।

স্থানীয় আনোয়ার হোসেন বলেন, মসজিদের ফ্লোরের নিচ দিয়ে যাওয়া লাইন থেকে গ্যাস লিক হয়ে ‘গ্যাস চেম্বার’-এ পরিণত হয়েছিল। এসি মসজিদের দরজা-জানালা বন্ধই থাকে। ফলে এটি একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়।

উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে এশার নামাজের সময় তল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ৪০ জনের বেশি মুসল্লি দগ্ধ হন। দগ্ধদের মধ্যে ৩৭ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিস্ফোরণে মসজিদের ছয়টি এসি পুড়ে গেছে। জানালার কাচ উড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

 



Topic:


Leave your comment here:


Most Popular News
Top