Dhaka Sunday, May 12, 2024

ছিঁচকে চোর দেলোয়ার এখন ‘গ্যাং লিডার’


Published:
2020-10-06 18:45:17 BdST

Update:
2024-05-12 06:29:29 BdST

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে রাতের আঁধারে ঘরে ঢুকে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় হওয়া মামলার ৯ আসামিই স্থানীয় ‘মামা বাহিনী’র সদস্য এবং বাহিনীটির প্রধান দেলোয়ারের নির্দেশেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

গতকাল সোমবার দেলোয়ারসহ মামলার প্রধান আসামি বাদলকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাবের কর্মকর্তারা। গৃহবধূ নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত এই ‘মামা বাহিনী’র প্রধান দেলোয়ার একসময় বেগমগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক ছিল। পরে সিএনজিচালকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চুরি, ছিনতাইসহ এলাকায় নানা অপকর্ম শুরু করে।

এরই মধ্যে দেলোয়ার ডাক পেয়ে যায় বেগমগঞ্জের হাজীপুর এলাকার দুটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধানের। এর একজন সুমন ও অন্যজন সম্রাট। সুমন ও সম্রাট নিজেদের বাহিনী দিয়ে বেগমগঞ্জজুড়ে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। টাকার বিনিময়ে কখনো সুমনের হয়ে আবার কখনো সম্রাটের হয়ে অপরাধে জড়াত দেলোয়ার। আর এ দুই বাহিনীর হয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে অপরাধজগতে প্রভাব তৈরি করে সে।

দেলোয়ার প্রথমদিকে এখলাসপুর ইউনিয়নসহ আশপাশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে তার নিয়ন্ত্রিত ‘মামা বাহিনী’ দিয়ে। পরে একসময় বাহিনীর প্রধান হয়ে ওঠে। চুরি, ছিনতাই ও খুনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। তারা জানায়, দেলোয়ারের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। তবে এজন্য তাকে খুব একটা থানা-পুলিশের মুখোমুখি হতে হয়নি।

স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের শুরুর দিকে এখলাসপুরের একটি ওয়ার্ডের কর্মিসভায় স্থানীয় এমপি মামুনুর রশীদ কিরণের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করে দেলোয়ার। এর আগে কিরণের স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে নিজে ও নিজের লোক জমায়েত করে এলাকায় পরিচিতি তৈরি করে। এভাবে স্থানীয় এমপি কিরণের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় দেলোয়ারের।

কিরণের অনুষ্ঠানগুলোতে যাতায়াত থাকায় আওয়ামী লীগকর্মী হিসেবেই সবাই চিনতে থাকে দেলোয়ারকে। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে পাত্তা দিয়ে চলতে শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নেয় দেলোয়ার। গড়ে তোলে ‘মামা বাহিনী’ নামে একটি বাহিনী। এ বাহিনীর অন্যতম সদস্য বাদল, বাহার ও জামাল।

 অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচির অগ্রভাগে দেখা যেত দেলোয়ারকে। স্থানীয় এমপি কিরণের কোনো কোনো কর্মসূচির সভামঞ্চেও থাকত। এভাবেই সিএনজিচালক, তারপর ছিঁচকে চোর এবং সর্বশেষ রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে সে।

এলাকার লোকজন তাকে ‘দেলোয়ার মামা’ বলে ডাকে। তাই একসময় তার গ্রুপটির নাম হয়ে পড়ে ‘মামা গ্রুপ’। আগে কোনো দল না করায় হাজীপুরের সুমনের বাহিনীতে কাজ করত। সুমন বিএনপির কর্মী ছিল। পরে আওয়ামী লীগে ভেড়ায় সম্রাট বাহিনীর হয়ে কাজ শুরু করে দেলোয়ার। সম্রাট আওয়ামী লীগকর্মী হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া দেলোয়ারের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে রয়েছেন এখলাসপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগ সভাপতি ও এলাকায় জমির দালালি করে মোটা টাকার মালিক হওয়া মাজহারুল।

এলাকাবাসী বলছে, গৃহবধূ নির্যাতনের ঘটনায় আলোচনায় আসার পর দেলোয়ারকে বাঁচাতে ইতিমধ্যে নানামুখী তদবির শুরু হয়েছে। এলাকায় চাউর করা হচ্ছে, ঘটনাটি দেলোয়ার বাহিনী বা মামা বাহিনী করলেও ঘটনার দিন দেলোয়ার সেখানে উপস্থিত ছিল না। ভিডিও ফুটেজেও তার ছবি নেই বলে প্রচার করা হচ্ছে। মামলার বাদী নিজেও ঘটনার দিন রাতে অপরাধীরা লাইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, দুয়েকজন ছাড়া হামলাকারী কাউকে চিনতে পারেননি। দেলোয়ার ঘটনাস্থলে ছিল কি না সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তবে এলাকার লোকজন বলছেন, প্রভাবশালী মহল মামলার বাদী নারীকে চাপ দিয়ে দেলোয়ারকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি এলাকাবাসীর ভেতরে নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, দেলোয়ারকে রক্ষা করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। তারা আরও বলছেন, ভিডিও ফুটেজে জামাল নামে একজনের উপস্থিতি দেখা গেলেও মামলা থেকে তার নামও বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি রহস্যজনক।

ঘটনাটি গত ২ সেপ্টেম্বর রাতের। এখলাসপুরের বাবার বাড়ির নিজ ঘরে বর্বরতার শিকার হন ৩৫ বছর বয়সী ওই নারী। সেদিন রাতে স্বামীও তার সঙ্গে ছিলেন। তবে দেলোয়ার বাহিনী ও তার দলবল ওই নারীকে চরিত্রহীন দাবি করে নির্যাতন চালায়।

এ ঘটনা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন অবগত হলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বিষয়টি ওই মেম্বার থেকে শুরু করে জানতেন এখলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও। এছাড়া ওই নারীর আশপাশের বাড়ির কিছু মানুষও ঘটনার দিন রাতের বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন। থানা পুলিশও লোকমুখে অবহিত হয় অনেক আগেই। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়নি কেউই।

দেলোয়ার বাহিনীর ব্যাপারে এলাকার মানুষের কিছুটা ভীতি কাজ করে। যেহেতু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেলোয়ারের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাই নির্যাতিত নারীর অভাবী পরিবারটিও কারও কাছে মুখ খোলেনি বরং পালিয়ে বেড়িয়েছে মানসম্মানের ভয়ে। ঘটনার পর দেলোয়ার বাহিনী ওই নারীকে নির্যাতনের দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে বেশ কয়েক দিন। টাকা দাবি ও অনৈতিক প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে ওই নারীকে।

তা না হলে ভিডিও ‘বাজারে ছেড়ে’ দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়। হুমকি-ধমকিতে টিকতে না পারায় অবশেষে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান নির্যাতিত ওই নারী। জানা গেছে, তার স্বামীও সঙ্গে চলে যান। তবে ঘটনা জানাজানির পর স্থানীয় থানা পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে এবং ওই নারী ও তার পরিবারকে তাদের হেফাজতে নেয়।

স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, কোনো কিছু আদায় করতে না পারায় এবং গ্রাম ছেড়ে ওই নারী ও তার পরিবার পালিয়ে যাওয়ায় ৩ অক্টোবর রাতে বেগমগঞ্জের ঘাবুয়া বাজারে বৈঠকে বসে নির্যাতনে জড়িতরা।

তারা পরিকল্পনা করে ভিডিওটি ছেড়ে দেওয়ার। ভিডিও প্রচারের দিন গত রবিবার দুপুর পর্যন্ত ঘাবুয়া বাজারে অবস্থান ছিল দেলোয়ারের। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর গা-ঢাকা দেয়। এলাকাবাসী মনে করছে, মামা বাহিনীর প্রধানকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে স্থানীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশের কারণে।

দেলোয়ারের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ মামুনুর রশীদ কিরণ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেলোয়ারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ নেই। আমি সন্ত্রাসী লালন-পালন করি না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে তার (দেলোয়ার) ছবি থাকতেই পারে। রাজনীতি করি, কতজন আসে। সবাইকে তো আমি চিনি না। এটা ঠিক গত বছর সে একটি কর্মিসভায় এসেছে, ফুল দিয়েছে আমাকে। তবে সে কোনো পদ-পদবিতে নেই। আমি নিকৃষ্টতম এই অপরাধের শাস্তি চাই। এখানে যে-ই জড়িত থাকুক, সবাইকে আইনের আওতায় আসতে হবে।’



Topic:


Leave your comment here:


Most Popular News
Top