Dhaka Monday, May 13, 2024

ডাক ভবন নির্মাণ ও প্রকল্পে কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ

উদ্যোক্তাদের সাড়ে আট হাজার ল্যাপটপের টাকা ডিজি সুধাংশুর পকেটে!


Published:
2020-10-23 18:29:53 BdST

Update:
2024-05-13 14:11:58 BdST

বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণ, পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি প্রকল্পের কেনাকাটা, পয়েন্ট অব সেল (পওস) মেশিন কেনায় অনিয়ম, উদ্যোক্তাদের সাড়ে আট হাজার ল্যাপটপসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ না করে বিল তুলে নেওয়াসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এরই অংশ হিসেবে গত ১ সেপ্টেম্বর ডাক অধিদপ্তরের ডিজি সুধাংশু শেখর ভদ্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন অভিযোগ অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন। আর গতকাল বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরের ভবন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) এইচএম গিয়াসউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা  জানান, ডাক বিভাগের প্রকল্পের কেনাকাটাসহ কিছু বিষয়ে ঢালাও অভিযোগ এসেছে। সেগুলো এখন যাচাই-বাছাই চলছে। প্রকৃত অপরাধী শনাক্তে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা হচ্ছে। এজন্য যাকে প্রয়োজন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও ডাক অধিদপ্তরের কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে। সেগুলোও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, সুধাংশু শেখর ভদ্র নিজের নামে না রেখে আত্মীয়স্বজনদের নামে অঢেল সম্পদ করেছেন। সারা দেশে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সাড়ে আট হাজার ল্যাপটপসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। অথচ বিল ভাউচারের মাধ্যমে এ বাবদ টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

তিনি আউটসোর্সিংয়ের কাজে নিয়োজিত জনবলের চেয়ে অতিরিক্ত বিল তুলে আত্মসাৎ করেছেন। ই-সেন্টার স্থাপন ও ঠিকাদারি কাজে অনিয়মসহ বেশুমার অভিযোগ সুধাংশুর বিরুদ্ধে। ডাক বিভাগের ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ৯৯ কোটি টাকার কাজের মধ্যে ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১২ থেকে ’১৭ সালে সম্পন্ন হওয়া এ প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে তাকে দুদক জেরা করেছে।

দুদকের এক পরিচালক বলেন, ‘ডাক বিভাগের প্রায় ৫৪১ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের একটি প্রকল্পের ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অস্তিত্বহীন কেন্দ্রের নামে অর্থ বরাদ্দ করে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রকল্পের ৩৮০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব পাওয়া গেলেও সেই টাকায় কেনা সরঞ্জাম অকেজো, নষ্ট ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।’

কমিশনের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ডাক বিভাগের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠিয়েছে। এ প্রতিবেদনের বরাতে দুদকের অভিযোগে বলা হয়, বর্তমান মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি নামে ওই প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম করেছেন।

প্রকল্পের আওতায় পোস্টাল ক্যাশ কার্ডধারী গ্রাহকদের সেবা দিতে প্রয়োজনীয় ‘পয়েন্ট অব সেল’ (পওস) মেশিন কেনা হয় ১৭ হাজার পিস, যার মধ্যে মাত্র ৭০৪টি মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। ফিঙ্গার ভেইন মেশিন ১০ হাজারটির মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ৬৪৩টি। এছাড়া প্রকল্প কর্র্তৃপক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় ৫৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকার পওস মেশিন ও ১৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার ফিঙ্গার ভেইন মেশিন কোনো কাজে আসছে না।

অভিযোগ অনুযায়ী, গ্রামীণ পর্যায়ে ডিজিটাল সেবা দিতে ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি একনেক পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন ডাক বিভাগ ২০১২ থেকে ’১৭ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রথমে এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন ডাক বিভাগের উপমহাপরিচালক মো. আলাউদ্দিন। তার দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তিন বছর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সুধাংশু শেখর ভদ্র, যিনি বর্তমানে অধিদপ্তরের জিডি।

প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের সাড়ে আট হাজার ডাকঘরের জন্য ৫৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকায় ১৭ হাজার পওস মেশিন, ১৯ কোটি ৬২ লাখ টাকায় ১০ হাজার ফিঙ্গার ভেইন মেশিন, ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকায় ৮ হাজার ১০০ ফটোপ্রিন্টার, ২ কোটি ৩ লাখ টাকায় ৩২৬টি কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকায় ৭ হাজার ২৫০টি লেজার প্রিন্টার, ১০২ কোটি ৩৪ টাকায় ২১ হাজার ৪৫টি ল্যাপটপ (দোয়েল), ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকায় ৭ হাজার ৫১০ সেট ফার্নিচার, ৪৭ কোটি ২৩ লাখ টাকায় ১ হাজার ৫০০টি সোলার সিস্টেম, ৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় একটি জিপসহ ১০টি ডাবল কেবিন পিকআপ, ১৫ কোটি ১১ লাখ টাকায় ইউপিএসসহ ৫০০টি সার্ভার, ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় ৫০০টি চিপ বেইজ কার্ড ও ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকায় ৮ হাজার ২৭০টি দোয়েল ওয়েভ ক্যাম কেনা হয়।

অনুমোদিত প্রকল্পে ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হলেও প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৩৮০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে ১৬০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ওই টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে কি না সেটা উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শেষ হলেও টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) ও আইটিসিএলের সরবরাহ চালানে ২০১৫ থেকে ’১৯ সালের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ কোনো কোনো সরঞ্জাম প্রকল্প মেয়াদ শেষের দুই বছর পর সরবরাহ করা হয়েছে।

দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ অনুসারে, ১৭ হাজার পওস মেশিনের মধ্যে ১৪ হাজার ১২৯টি মেশিন মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। অন্যগুলো ডাক মহাপরিচালকের দপ্তরে পড়ে আছে। মাঠপর্যায়ে পাঠানো মেশিনগুলো অব্যবহৃত ও অবিতরণকৃত অবস্থায় রয়েছে। খুলনার ডাক বিভাগীয় কার্যালয়ে ৮৫০টি পওস মেশিন ও ৬০০টি ফিঙ্গার ভেইন মেশিন প্যাকেটবন্দি পাওয়া গেছে। এছাড়া ডাক অধিদপ্তরের ৪০৯টি পওস মেশিন স্থানীয় সরকারের ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট (আইএসপিপি)-যত্ন প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, একই ডাকঘরের নাম একাধিকবার লিখে সাড়ে আট হাজারের তালিকা পূর্ণ করা হয়েছে। এভাবে নামে-বেনামে খরচ দেখিয়ে সুধাংশু প্রকল্পের অর্থ লোপাট করেছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, গ্রামীণ জনসাধারণকে ডিজিটাল সেবা দেওয়ার কথা বলে শত শত কোটি লোপাট করেছেন ডিজি সুধাংশু শেখর ভদ্র। কেনাকাটা থেকে শুরু করে ডিজিটাল পোস্ট সেন্টার স্থাপন সবখানেই হয়েছে বেশুমার দুর্নীতি। শুধু তাই নয়, বহু ডিজিটাল সেন্টারের অস্তিত্ব না থাকলেও সেসবের নামে তিনি তুলে নিয়েছেন ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে সুধাংশু শেখর ভদ্রের দপ্তরে ফোন করা হলে তিনি নেই বলে জানানো হয়। পরে তার মোবাইল নম্বর চাওয়া হলে, তিনি কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না বলে জানানো হয়।



Topic:


Leave your comment here:


Most Popular News
Top